<Transparent Logo
Scroll down

anisujjaman

আনিসুজ্জামান
২৩ জুলাই, ২০২০

গত ১৪ মে ২০২০ এই করোনা-আক্রান্ত লকডাউন সময়ে চলে গেলেন বিশিষ্ট প্রাবন্ধিক চিন্তাবিদ ও শিক্ষক আনিসুজ্জামান। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দে কলকাতায় জন্ম হলেও দেশভাগের পর তাঁরা সপরিবারে পূর্ব-পাকিস্তানে চলে যান। তিনি নিরন্তর সন্ধান করে গেছেন বাংলা ও বাঙালির স্বরূপ। ফলস্বরূপ আমরা পেয়েছি তাঁর অন্তর্দৃষ্টিতে আলোকিত বহু মূল্যবান রচনা। তবে শুধু সাহিত্যসৃষ্টির বৃত্তে তাঁর পরিচয়কে আটকে রাখলে ভুল হবে, তিনি ছিলেন মুক্তমনা অবিচারের বিরুদ্ধে সদাপ্রতিবাদী এক আদর্শ ব্যক্তিত্ব। ...

কী আছে ভিতরে

বিশিষ্ট চিন্তাবিদ প্রাবন্ধিক শিক্ষক আনিসুজ্জামানের ‘ইহজাগতিকতা'র অবসান ঘটল গত ১৪ মে ২০২০। সাঙ্গ হল তাঁর ইন্দ্রিয়গোচর ও যুক্তিগ্রাহ্য জগৎ এবং জীবন-মৃত্যুর সীমায় আবদ্ধ অস্তিত্ব সম্পর্কে যাবতীয় উৎকণ্ঠা। পরলোক-পরকাল কিংবা অতিপ্রাকৃত অথবা আত্মায় তাঁর চিন্তায়
কোনো প্রশ্রয় ছিল না। কারণ তিনি চোখ খুলে দেখায় বিশ্বাসী ছিলেন, চোখ বন্ধ করে দেখায় নয়। অতিপ্রাকৃতকে নির্ভর করে কখনই দুনিয়াকে বশীভূত করতে চাননি তিনি, কাজের মাধ্যমে সৎকর্মের মধ্যে দিয়ে পারিপার্শ্বিক পৃথিবী ও সহনাগরিকদের স্বাচ্ছন্দ্য চেয়েছেন আজীবন। ইহজীবন ছিল তাঁর কর্মের এক এবং একমাত্র চারণভূমি, মনোরথের ঠিকানা। তাই তিনি ছিলেন সুখদুঃখ-বিরহ-মিলন-পরিপূর্ণ মানবজীবনের সাধক। সে-জীবনে তাঁর নিজের জগৎ, ছোটোখাটো চাওয়াপাওয়া নিয়ে উদ্বিগ্নতা ছিল কম, যাবতীয় চিন্তা উদ‍্গ্রীব উচাটনতা সদাজাগরূক সচেতনতা ছিল পারিপার্শ্বিক বিশ্ব ও তার নাগরিকদের কেন্দ্র করে।
মানবজীবনকে দুঃসময় জ্ঞান না-করে তিনি সে-জীবনে সুখের সন্ধান করায় বিশ্বাসী ছিলেন। সর্বোপরি তিনি ছিলেন মানবতার জয়গানে আস্থাশীল। আস্থা রাখতেন সাংস্কৃতিক বহুত্বে, আর এই বিশ্বাসের বলে তিনি কখনোই অন্য সংস্কৃতির প্রতি বিরূপ মনোভাব প্রকাশ করতেন না, বরং সে বহুত্ব ক্ষুণ্ণ হলে আঘাত পেয়েছেন বারবার। তাই আজীবন প্রচার করেছেন: “মূলধারার সংস্কৃতির সঙ্গে নৃতাত্ত্বিক গোষ্ঠীগুলোর সংস্কৃতিকে যেন আমরা যথাযথ মর্যাদা দিই; অন্যদিকে এক ধর্মসম্প্রদায় যেন অন্য ধর্মসম্প্রদায়ের ওপর প্রাধান্য বিস্তার না করে।" (‘সাংস্কৃতিক বহুত্ব', ইহজাগতিকতা ও অন্যান্য, কলকাতা, ২০১২, পৃ ৩৮)।
ধর্ম বাঙালির সংস্কৃতির একটি উপাদান মাত্র। স্বভাবতই বর্তমান পরিস্থিততে তাঁর সাংস্কৃতিক বহুত্বের বিশ্বাসে আঘাত লেগেছিল বলেই তিনি ব্যক্ত করেন: “নিজের দেশে ধর্মনিরপেক্ষতা খুইয়ে আমি যেমন দুঃখিত, তেমনি ভারতে হিন্দুত্বের জাগরণে আমি ভীত।" (‘সাংস্কৃতিক বহুত্ব', ইহজাগতিকতা ও অন্যান্য, কলকাতা, ২০১২, পৃ ৩৯)।
আবার বাঙালির সংস্কৃতি উচ্চ ও নিম্নবর্গের ভিতর এক নয়, ধর্ম ও অঞ্চলভেদে আলাদা হলেও অন্তর্লীন একটি বন্ধন আছে—তাই তাঁর মনে হয়েছে, “[...] ধর্মভেদ ও শ্রেণিভেদ সত্ত্বেও বাঙালি সংস্কৃতিতে সহজ সরল মানবিকতার প্রাধান্য আছে পূর্বাপর। এই মানবস্বীকৃতি, এই মানবপ্রাধান্য, বাংলা সংস্কৃতির একটা বড়ো গৌরব।" (‘বাঙালি সংস্কৃতি প্রসঙ্গে', ইহজাগতিকতা ও অন্যান্য, কলকাতা, ২০১২)।
বাঙালির এই আত্মপরিচয় লাভের জন্য বিংশ শতাব্দীতে বাংলাদেশ নামক স্বাধীন রাষ্ট্র প্রতিষ্ঠা ছিল এক অগ্রণী পদক্ষেপ, যে-সংগ্রামে আনিসুজ্জামান ছিলেন একজন প্রথম সারির সৈনিক।
শুধু বাংলাদেশের স্বাধীন রাষ্ট্র হিসাবে উত্থানের তিনি সাক্ষী নন, তিনি প্রত্যক্ষ করেছিলেন স্বাধীন রাষ্ট্র রূপে ভারতবর্ষের আত্মপ্রকাশও। ১৯৩৭ খ্রিস্টাব্দের ১৮ ফেব্রুয়ারি অবিভক্ত বঙ্গদেশে কলকাতা শহরের এন্টালিতে (৩১ ক্যান্টোফার লেনে) জন্ম আবু তৈয়ব মহম্মদ আনিসুজ্জামানের। তাঁর শিক্ষার শুরু পার্ক সার্কাসের একটি স্কুলে। তারপর তাঁরা পূর্ব পাকিস্তানে বসবাস শুরু করেন এব‍ং প্রথমে খুলনা ও পরে ঢাকায় তিনি শিক্ষালাভ করেন।
কিন্তু নতুন দ্বিখণ্ডিত রাষ্ট্র গঠিত হলেও কোনো প্রকারে পূর্ব পাকিস্তানে বসবাসকারী বাঙালিদের মনোবাঞ্ছা পূর্ণ হয়নি। বাংলা ভাষার অধিকার নিয়ে পাকিস্তানি শাসকদের সঙ্গে প্রতিনিয়ত সংঘাত শুরু হয়। যার প্রত্যক্ষ বহিঃপ্রকাশ ১৯৫২-র ভাষা আন্দোলন। এই আন্দোলনের সামনের সারির একজন হিসাবে আনিসুজ্জামান রচনা করলেন রাষ্ট্রভাষা আন্দোলন কী ও কেন? শীর্ষক পুস্তিকা। তখনও তিনি ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবেশ করেননি। এরপরের বছর ১৯৫৩-ত‍ে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র হিসাবে প্রবেশ করার পর থেকে আমৃত্যু কোনো-না-কোনোভাবে সে-প্রতিষ্ঠানের সঙ্গে তিনি যুক্ত থেকেছেন আর নিরন্তর সন্ধান করে গেছেন বাংলা ও বাঙালির স্বরূপ। এর ফলস্বরূপ আমরা পেয়েছি তাঁর অন্তর্দৃষ্টিতে আলোকিত বহু মূল্যবান রচনা—কখনও পুস্তকাকারে, কখনও-বা গবেষণা-সন্দর্ভ রূপে, কখনও বক্তৃতায়, আবার কোনো সময়ে পত্রপত্রিকার দু-মলাটের ভিতর। স্বীকৃতি-সম্মাননাও তিনি পেয়েছেন অজস্র।
তবে শুধু সাহিত্যসৃষ্টির বৃত্তে তাঁর পরিচয়কে আটকে রাখলে ভুল হবে, তিনি ছিলেন মুক্তমনা অবিচারের বিরুদ্ধে সদাপ্রতিবাদী এক আদর্শ ব্যক্তিত্ব। বংশপরম্পরায় তিনি পেয়েছিলেন নিজের বিচার-বিবেচনা অনুযায়ী চলবার শিক্ষা। ব্রাহ্মপরিবারে মানুষ হয়েও তাঁর পিতামহ আবদুর রহিম যেমন নিজের ধর্মীয় সত্তাকে পুনরাবিষ্কার করেন, তেমনি কোনো পরিস্থিতিতে চাপের কাছে নত হয়ে আনিসুজ্জামান হারাননি তাঁর প্রতিবাদী সত্তাকে। প্রথম জীবনে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্র আনিসুজ্জামান যখন নানা প্রতিবাদী কর্মকাণ্ডে মুখর তখন তাঁর “আব্বার কোনো সাংবাদিক-লেখক বন্ধু আমার [আনিসুজ্জামান] সম্পর্কে তাঁর কাছে এই বলে অনুযোগ করেছিলেন যে, অমন ব্যক্তির [ইসলাম-বিষয়ক গ্রন্থাদির প্রণেতা আবদুর রহিমের] পৌত্র হয়েও আমি বিপরীত পথে অগ্রসর হচ্ছি। আব্বা তাঁকে বলেছিলেন, ‘দেখেন, আমার বাপ ব্রাহ্ম পরিবারে মানুষ হয়ে ইসলাম-বিষয়ে লিখতে পেরেছিলেন এবং নিজের বিবেক-অনুযায়ী চলেছিলেন। তাঁর পোতা [পৌত্র] হয়ে আমার ছেলে যদি নিজের বিচারবুদ্ধি-অনুসারে চলতে চায়, তাহলে আমি তাকে বারণ করতে পারি না'।" (কাল নিরবধি, ঢাকা, পৃ ১৬)
শুরু থেকেই পার্থিব বৃত্তের মধ্যে জীবনকে গণ্ডিবদ্ধ না-রেখে, তিনি সকল মত-ধর্মের ঊর্ধ্বে নিরপেক্ষ দৃষ্টিতে এক ‘ইহজাগতিক' বিশ্বাস প্রতিষ্ঠা করতে চেয়েছেন। ফলস্বরূপ পেয়েছেন বহুমানুষের আন্তরিক শ্রদ্ধা ও ভালোবাসা। তাঁর প্রতিবাদী কণ্ঠ কোনো পরিস্থিতিতেই রুদ্ধ করা যায়নি।
এমনই এক ব্যক্তিত্বের তিরোধানে এই পুস্তিকাটি করোনা বিধ্বস্ত লকডাউন সময়ে ‘হরপ্পা'-র একটি ক্ষুদ্র শ্রদ্ধার্ঘ্য।
আশা রাখি, আনিসুজ্জামানকে নিয়ে স্মরণ-সম্মাননা ও গবেষণা চলবে—তবে এই সংকটসময়ে মেরুদণ্ড সোজা রেখে তাঁর দেখানো পথে অগ্রসর হওয়াই হবে তাঁর প্রতি আমাদের সব থেকে বড়ো শ্রদ্ধার্ঘ্য—“কথা ফুরোয় না, সময় ফুরিয়ে যায়। লেখার ছেদ টানা যায়, জীবন কিন্তু প্রবহমান।। জীবন ক্রমাগত সামনের দিকে চলে। আমাদের পথচলা এক সময়ে থেমে যায়, জীবন থামে না।" (বিপুলা পৃথিবী, ঢাকা, ২০১৫, পৃ ৫১৮)

ডাউনলোড করুন

প্রকাশকাল: ২৩ জুলাই, ২০২০
প্রচ্ছদ অলংকরণ ও শিল্প-নির্দেশনা: সোমনাথ ঘোষ

সম্পাদক: সৈকত মুখার্জি

বিষয়সূচি
অধ্যাপক আনিসুজ্জামান
আবদুল্লাহ আবু সায়ীদ
একজন ঐহিক তীর্থংকর যেমন দেখেছি
মিহির সেনগুপ্ত
আনিসুজ্জামানের গবেষণা ও জীবনাদর্শ
গোলাম মুস্তাফা
আমার শিক্ষক আনিসুজ্জামান
গোলাম মুরশিদ
একটি চিঠি
ভূঁইয়া ইকবাল
বিদ্বান আনিসুজ্জামান
আহমদ কবির
আনিসুজ্জামান এবং একটি ধ্রুপদি গ্রন্থ
মহীবুল আজিজ
বাঙালির সংস্কৃতি:
অধ্যাপক আনিসুজ্জামানের বক্তব্য নিয়ে কিছু কথা
আখতার হোসেন খান
আনিসুজ্জামান: শিক্ষকতা
সাহিত্যিকতা ও সামাজিকতা
আহমাদ মাযহার

গ্রাহক হোন
হরপ্পার গ্রাহক হতে গেলে বছরে তিনটি সংখ্যার জন্য মোট পাঁচশো টাকা দিতে হয়। (ডাকমাশুল আলাদা)
যোগাযোগ করুন ই-মেলে অথবা ফোনে কথা বলুন।

সরাসরি প্রাপ্তিস্থান
• হরপ্পার পরিবেশক পশ্চিমবঙ্গে অক্ষর প্রকাশনী, ১৮এ টেমার লেন, কলকাতা-৯ ও বাংলাদেশে বাতিঘর।
• কলেজস্ট্রিটে পাতিরাম, ধ্যানবিন্দু, দেজ, দে বুকস্টোর, উল্টোডাঙায় সুনীলদার দোকান, রাসবিহারী মোড়ে কল্যাণদার দোকান, রিড বেঙ্গলি বুক স্টোর, শান্তিনিকেতনে রামকৃষ্ণর দোকানের মতো বহু স্টলে হরপ্পা নিয়মিত পাওয়া যায়। এছাড়া অনলাইনে হরপ্পা বিক্রি হয়।
• পত্রিকা পেতে আপনি দপ্তরেও মেল করতে পারেন।

মুদ্রিত সংখ্যা
হরপ্পার যাত্রা শুরু ২০১৭-র অক্টোবর মাসে চতুর্মাসিক পত্রিকা হরপ্পা লিখন চিত্রণ-এর প্রকাশলগ্নে। মূলত সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে হরপ্পা আত্মপ্রকাশ করে বাংলার শিল্পসংস্কৃতি আচার অনুষ্ঠান রীতিনীতি পালাপার্বণ প্রভৃতি নানা বিষয়কে দু-মলাটের ভিতর নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরার লক্ষ্যে। দেখবেন চলুন...