<Transparent Logo
Scroll down

gavir nirjane

গভীর নির্জনে
১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১

২০১৭-য় পথ-চলা শুরু করা ‘হরপ্পা’-র সলতে-পাকানোর দিন থেকে সুধীর চক্রবর্তী ছিলেন ‘হরপ্পা লিখন চিত্রণ’ পত্রিকার অন্যতম প্রধান উপদেষ্টা, উৎসাহদাতা ও উপদেশক। ‘হরপ্পা'-র অগ্রসরপথ মসৃণ করতে তাঁর মৃত্যু (১৫ ডিসেম্বর ২০২০) অবধি মুদ্রিত ন-টি সংখ্যার আটটিতে শুধুমাত্র লিখেই ক্ষান্ত হননি ছিয়াশি বছরের এই প্রবীণ, পরম সুহৃদের মতো পত্রিকার বিপণনের মতো বিষয়েও সরাসরি সহায়তা করেছেন। ‘গভীর নির্জনে’ পুস্তিকাটি তাঁর প্রতি ‘হরপ্পা’-র গভীর শ্রদ্ধাঞ্জলি। ...

কী আছে ভিতরে

‘দেশ’ পত্রিকায় (২ডিসেম্বর ২০২০) বন্ধুবর সৌমিত্রের স্মরণলেখ (‘আমার বন্ধু পুলু’) লিখতে গিয়ে প্রথমেই সুধীর চক্রবর্তীর মনে পড়েছিল অতুলপ্রসাদ সেনের মৃত্যুতে শোকস্তব্ধ রবীন্দ্রনাথের কবিতাংশটি (রচনাকাল ১৯ ভাদ্র ১৩৪১)। রবীন্দ্রনাথ ও অতুলপ্রসাদের বয়সের ব্যবধান ছিল দশ বছর। কিন্তু সৌমিত্র চট্টোপাধ্যায় ও সুধীর চক্রবর্তী সমবয়সি, তাঁদের বন্ধুজীবনও দীর্ঘ। তবে ২০১৭-য় পথ-চলা শুরু করা ‘হরপ্পা’-র সঙ্গে শ্রীচক্রবর্তীর বন্ধুতা দীর্ঘ নাহলেও ছিল গভীর। সলতে-পাকানোর দিন থেকে তিনি ছিলেন ‘হরপ্পা লিখন চিত্রণ’ পত্রিকার অন্যতম প্রধান উপদেষ্টা, উৎসাহদাতা ও উপদেশক। ‘হরপ্পা'-র অগ্রসরপথ মসৃণ করতে তাঁর মৃত্যু (১৫ ডিসেম্বর ২০২০) অবধি মুদ্রিত ন-টি সংখ্যার আটটিতে শুধুমাত্র লিখেই ক্ষান্ত হননি ছিয়াশি বছরের এই প্রবীণ, পরম সুহৃদের মতো সরাসরি পত্রিকার বিপণনের মতো বিষয়েও সরাসরি সহায়তা করেছেন। দীর্ঘ সম্পাদনা-অভিজ্ঞতায় ঋদ্ধতার কারণে কোনো পত্রিকার সার্থক প্রকাশনার প্রত্যেকটি বিষয় সম্বন্ধে তিনি অবহিত ছিলেন। ‘ধ্রুবপদ’ বার্ষিক সংকলন প্রকাশের সময় থেকেই তাঁর সুষ্ঠু পরিকল্পনা রচনা, তার সময়োপযোগী পরিবর্তন ও রূপায়ণের সুস্পষ্ট আভাস ধরা থাকত পত্রিকার গোড়াতেই ‘আত্মপক্ষ’ অংশে। ১৯৯৬-এ প্রকাশিত প্রথম সংকলনে তিনি ‘ধ্রুবপদ’-এর আত্মপ্রকাশ সংবাদ দিয়ে তার বিষয়বস্তু, সম্ভাব্য বাৎসরিক প্রকাশকাল ইত্যাদি জানিয়ে দেন: “প্রতি বছর পশ্চিমবঙ্গের কোনো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয় সম্পর্কে সারা বছরের প্রস্তুতি নিয়ে সুচিন্তিত কিছু রচনা সম্ভারে এটি প্রকাশিত হবে। বিষয় অনুসারে সংকলনের অবয়ব ও আর্থিক মূল্যের তারতম্য ভবিষ্যতে ঘটতে পারে। সংকলনের প্রকাশকাল প্রতিবছরের কলকাতা বইমেলার তারিখের সংলগ্ন থাকবে।” তিনি উল্লেখ করতে ভোলেননি ‘সংকলন-সম্পাদকের কোনো ব্যবসায়িক অভিপ্রায় নেই’ বা ‘সংকলন কোনো সাহিত্যগোষ্ঠি বা সাংস্কৃতিক প্রয়াসের সামূহিক মুখপত্র নয়’। ‘সম্পাদক এককভাবে এর ভালোমন্দের দায়ভাগী’ বলে তিনি যেমন দায়িত্বভার নিজের কাঁধে তুলে নিয়েছিলেন, তেমনই কৃতজ্ঞচিত্তে স্মরণ করেছিলেন সেইসব শুভাকাঙ্ক্ষীদের যাঁরা তাঁকে ‘লেখা দিয়ে, অনুদান দিয়ে বা বিজ্ঞাপন দিয়ে সহায়তা করেছিলেন’।
প্রথম বছরেই সাড়া জাগানো পত্রিকাটির দ্বিতীয় বছরে বিষয় ছিল বাংলার বাউল ফকির। অবয়ব ও বিক্রয়মূল্য ছিল অপরিবর্তিত। তবে পত্রিকাটিকে দর্শনীয় করার তাগিদে সংযোজিত হয়েছিল নন্দলাল বসু থেকে সাম্প্রতিক কাল অবধি আঁকা পঞ্চাশজন শিল্পীর চিত্র।
তৃতীয় বছর ‘বাংলা গান’ ছিল ‘ধ্রুবপদ’ সংকলনের বিষয়। সম্পাদক এই সংখ্যা থেকে বিজ্ঞাপন সম্পূর্ণভাবে বর্জন করেন। প্রকাশকালও বিলম্বিত হয়— বইমেলার বদলে নববর্ষ। রদবদল হয় প্রথম সংখ্যায় ঘোষিত বক্তব্যের: “এই সংকলন কোনো সাহিত্যগোষ্ঠি বা সাংস্কৃতিক প্রতিষ্ঠানের সামূহিক মুখপত্র নয়। বছরে একবার একটি নির্দিষ্ট প্রসঙ্গ নিয়ে এর বিষয়বস্তু ও রচনাগুলি বিন্যস্ত। সম্পাদক এককভাবে এই সংকলনের ভালোমন্দের দায়ভাগী। তবে তাকে লেখা দিয়ে লেখকবৃন্দ ও অন্যান্য আনুকূল্য দিয়ে বেশ কজন এর সফলতার অংশী। সংকলনের পরিকল্পনা, লেখক নির্বাচন, লেখা সংগ্রহ, প্রুফ দেখা, মুদ্রণের বিন্যাস এবং অঙ্গসৌষ্ঠব সবই সম্পাদকের সানন্দ কৃত্য। পাঠকদের খুশি করা নয়, এ সংকলনের লক্ষ্য কোনো একটি গুরুত্বপূর্ণ বিষয়ের উন্মোচন ও অবলোকন। ‘ধ্রুবপদ’ প্রথম থেকেই নান্দনিক দিক থেকেও সতর্ক ও সচেতন। সেইজন্য চিত্ৰণ কাৰ্য, অলংকরণ, অক্ষরবিন্যাস ও বর্ণলিপির ব্যাপারগুলি সাগ্রহে করা হয়ে থাকে। আমরা স্বস্তির সঙ্গে লক্ষ করছি ‘ধ্রুবপদ’ ক্রমশই সংগ্রাহকদের পক্ষে রোচক হয়ে উঠছে।”
চতুর্থ বছরে ‘আত্মপক্ষ’ থেকে জানা যায়, প্রথম দু-বছরের সংকলন নিঃশেষিত, শুধু তাই নয়—‘পরিমার্জিতভাবে ও নববিন্যাসে বই আকারে বার করতে হয়েছে সম্পাদককে এবং তা প্রকাশ করেছেন দুজন প্রকাশক’। প্রথম তিনবছরের সংকলন কোনো-না-কোনোভাবে গানের সঙ্গে সম্পর্কিত হলেও চতুর্থ বছরের সংকলনটি ছিল অভিনব—‘বুদ্ধিজীবীর নোটবই’—‘আধুনিক অর্থাৎ সচেতন, জিজ্ঞাসু ও সজীব মনের মানুষের জন্য বিচিত্র বিদ্যার সমাহার’। ১২৭ জন লেখক ১২১টি বিষয় নিয়ে লিখেছেন। ...অনেকের অংশগ্রহণে এই কোশগ্রন্থ প্রকাশের বিষয়ে প্রমথনাথ বিশীর উক্তিটি উল্লেখ করেছেন সম্পাদক: ‘যে কাজ সকলে মিলিয়া করিবার কাজ বাঙালি তাহা একা করে, বাঙালি একা অভিধান লেখে’। সম্পাদক স্মরণ করেছেন তাঁর অকাল প্রয়াত সহপাঠী ‘এক্ষণ’-সম্পাদক নির্মাল্য আচার্যকে, যিনি এই কাজটি শুরু করেছিলেন এবং ‘ধ্রুবপদ’ সে-কাজটি ‘তাঁর কৃতিত্ব মনে রেখে, সম্পূরক ও পূর্ণতর ভাবে’ করতে চেয়েছে মাত্র। লেখক কৃতজ্ঞতা স্বীকার করেছেন শঙ্খ ঘোষ, সৌরীন ভট্টাচার্য, শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়, রুশতি সেন ও অন্যান্য অনেকের কাছে যাঁরা কোনো-না-কোনো উপায়ে তাঁকে এই কাজে সাহায্য করেছেন। কারণ এ-কাজ তাঁর একার নয়, ‘১২৭টি বিচিত্র প্রসঙ্গে ও বিষয়ে ৯১ জনের রচনা সম্পাদনা করা একজনের পক্ষে ধৃষ্টতা’—তাই সে-চেষ্টা তিনি করেননি, বরং সংগ্রাহকের কাজটি করেছেন। সে-কারণে ‘ধ্রুবপদ’-এর ঘোষিত বক্তব্য ‘সম্পাদক এককভাবে এই সংকলনের ভালোমন্দের দায়ভাগী’ এই সংখ্যাটির ক্ষেত্রে প্রযোজ্য নয়।
পঞ্চম বর্ষে ‘ধ্রুবপদ’ পদার্পণ করার সময় তার বিগত সংখ্যাগুলি নিঃশেষিত হয়ে গেছে। “আধুনিক জীবন, সমাজ ও সংস্কৃতিকে ঘিরে সারা বিশ্বে [...] যেসব ভাবনার ঢেউ, জাগছে নানা তর্ক-বিতর্কের আমেজ‌—খুব সন্তর্পণে দায়বদ্ধ ‘ধ্রুবপদ’ হয়ে উঠছে তার ফোরাম কিংবা মননমঞ্চ"। পঞ্চম সংখ্যার বিষয় ‘যৌনতা ও সংস্কৃতি’।
টানা পাঁচ বছর মূল্যবৃদ্ধি বা অন্যান্য প্রতিকূলতা স্বীকার করে ‘ধ্রুবপদ’ পত্রিকার দাম না-বাড়লেও ষষ্ঠ বছর একশো থেকে দেড়শো হল পত্রিকার দাম। ‘আত্মপক্ষ’ অংশে কুণ্ঠার সঙ্গে সম্পাদক জানালেন তা। তবে এ সংখ্যার বিষয় ‘দৃশ্যরূপ’-এর সঙ্গে তাল মিলিয়ে ছবি ছাপাতে সে-খরচ বৃদ্ধি মেনে নেওয়াটাই ছিল স্বাভাবিক। উঠে এল ‘তথ্য ও সত্য, বৈপরীত্য ও স্ববিরোধ, জটিলতা ও সারল্যের গ্রন্থি’ এই দৃশ্যরূপের অন্তরালে নিগূঢ় কত অব্যক্ত সংলাপ।
ষষ্ঠ সংখ্যায় ‘কথার খেলাপ’ করে দাম বাড়ানোর পর লেখক পরবর্তী সংখ্যা একশো টাকায় আবার দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দিলেও সপ্তম সংখ্যার বিনিময় মূল্য একশো কুড়ি টাকা হয়। বিষয় নির্বাচিত হয় ‘অভিজ্ঞতা'। ঘটনা নয়, অভিজ্ঞতা মানে অর্জিত বোধভাষ্য, তত্ত্ব বা দর্শন। মোট বাইশজনের বিচিত্রধর্মী ও বিপরীত ভাবনার সমাবেশ এই সংকলনে ভিন্ন ধরনের চেহারা নিয়েছে।
দাম কমেনি ২০০৪-এও। সেবার কলকাতা বইমেলাকে উপলক্ষ্য করে প্রকাশিত ‘ধ্রুবপদ’-এর অষ্টম সংখ্যার বিষয় ছিল ‘রবীন্দ্রনাথ’। কিন্তু আবার রবীন্দ্রনাথ কেন—এ প্রশ্নের উত্তর সম্পাদক দিয়েছেন ‘আত্মপক্ষ’ অংশে: “[...] রবীন্দ্রনাথের মতো ব্যক্তিত্বের নানামুখী বিচ্ছুরণের শেষ নেই। যত দিন যাচ্ছে, তত তাঁর সৃষ্টির পাঠ এবং পুনর্পাঠ থেকে নতুন নতুন অনুভব হচ্ছে পাঠকের বা মননশীল ব্যক্তির—‘মহাকবির কল্পনাতেও ছিল না তার ছবি।’ [...] ‘আপনাকে এই জানা আমার ফুরাবে না। সেই জানার সঙ্গে সঙ্গে তোমায় চেনা’—বলেছিলেন রবীন্দ্রনাথ। কথাটি বিপরীত ভাবেও তো সত্যি—অর্থাৎ তাঁকে সম্পূর্ণত জানা আমাদের তরফে আজও ঘটেনি এবং তার ফলে আসেনি আত্মবীক্ষণের উদ্ভাস ও আত্মদীক্ষার সূচনা। তাই রবীন্দ্রনাথকে শুধু অবিনির্মাণের মধ্যে দিয়ে দেখা নয়—সেই সঙ্গে তাঁকে জানতে হবে বহুস্তরে ও ঘটনাক্রমের সঙ্গে মিলিয়ে, শিল্পী ও ব্যক্তিসত্তার যুগলসম্মিলনে"।
২০০৫-এ নবম বার্ষিক সংকলনের বিষয় নারীবিশ্ব—প্রশাসনিক উচ্চপদ অধিকার করা থেকে শুরু করে সংগঠন নির্মাণ, গণআন্দোলনে স্বাধিকার প্রতিষ্ঠা থেকে শুরু করে প্রতিবাদের নানা মঞ্চ গড়ে তোলা, আকাশবিহার থেকে রেসিং-কার চালানো, যৌনকর্মীদের সঙ্গে পথপরিক্রমা করা, কবি বা লেখক হিসেবে সতেজ কলম চালানো, সৌন্দর্য প্রতিযোগিতায় অংশগ্রহণের বিরোধিতা করা নারীর আধুনিক বিশ্বসমাজে অবস্থান সম্পর্কে এক বিশেষ গবেষণাধর্মী সংকলন।
২০০৬-এ এক দশক পার করে ‘ধ্রুবপদ’ ঘোষিত সময় অর্থাৎ জানুয়ারির শেষভাগ থেকে চারমাস পরে প্রকাশিত হয়। ২০০৫-এ চলচ্চিত্র ‘পথের পাঁচালী’র সুবর্ণ জয়ন্তী যতটা ঘনঘটায় উদ‍্যাপিত হয় ওই একই বছর উপন্যাস রচনার পঁচাত্তর বছর পূর্তি নিয়ে কিন্তু সেভাবে কোনো আগ্রহ বাঙালিমানসে দেখা যায়নি। তাই ‘উপন্যাস ও চলচ্চিত্রের যুগল উন্মোচনে, ৭৫ ও ৫০ বছর অতিক্রমণের আশ্চর্য মিলনবিন্দুকে স্মরণীয় করার মহান লক্ষ্যে’ ‘ধ্রুবপদ’-এর এই সেতুবন্ধের প্রয়াস।
একাদশ বর্ষে পত্রিকার বিষয় ছিল অন্যরকম বাঙালি—ষোলোজন ব্যতিক্রমী বাঙালির জীবন ও কর্ম নিয়ে এই সংকলন। এই সংকলনেরও দাম কমানো যায়নি। লক্ষণীয় সম্পাদকের লেখক-তালিকায় অন্তর্ভুক্তিও।
২০০৮-এ ‘ধ্রুবপদ'-প্রকাশের একটি যুগের অবসান হল—ছ-মাস বিলম্বে প্রকাশিত পত্রিকার দ্বাদশ এবং শেষ সংকলন—বিষয়: ‘গবেষণার অন্তরমহল’। গবেষণার ‘স্পন্দমান নেপথ্যলোক’টি তুলে ধরাই ছিল সংকলনের লক্ষ্য।
দ্বাদশ সংকলনটি প্রকাশ করে সম্পাদক ঘোষণা করেন দপ্তর বন্ধের কথা। জানান দেন এই বারো বছরের অভিজ্ঞতায় তাঁর ছিল না কোনো ‘ব্যর্থতা বা অক্ষমতা’, ‘আছে ব্রতপালনের সিদ্ধি, সময়োচিত সংবরণ ও সাফল্যের আত্মপ্রসাদ’। প্রথম সংখ্যায় যে ঘোষিত বার্তা ছিল তা রক্ষার আপ্রাণ চেষ্টা করেছেন তিনি। পত্রিকা কোনো গোষ্ঠীর মুখপত্র হয়নি, লাগেনি রাজনৈতিক ছোঁয়াচও। বাণিজ্যিক উদ্দেশ্য না-থাকায় উদ্বৃত্ত অর্থ পাঁচটি সংগঠনের মধ্যে ভাগ করে দেওয়ার প্রতিশ্রুতি দেন তিনি, পরে তা রক্ষাও করেন।
সফলভাবে বারো বছর পত্রিকা চালানোর পর ঘোষণা করে পত্রিকা বন্ধের নজির রাখা সম্পাদক হিসাবে সুধীর চক্রবর্তী অবশ্যই লেখক নয় সম্পাদক হিসেবেও অনুকরণীয়। শূন্য থেকে শুরু করে তিনি মাত্র বারো বছরে পত্রিকাটিকে এমন সাফল্যের চূড়ায় তুলেছিলেন যে পত্রিকা চলাকালীন বিগত সংখ্যাগুলির বেশ ক-টি গ্রন্থাকারে মুদ্রিত হয়েছিল, প্রকাশিত হয়েছিল ‘নির্বাচিত’ সংকলনও।
এমন সফল সম্পাদকের কাজ-শেখার সূচনা হয়েছিল অনেক আগেই কৃষ্ণনগর সরকারি মহাবিদ্যালয়ে পড়ার সময় থেকে। ১৯৫৩-তে তৃতীয় বর্ষের ছাত্র হিসাবে কলেজ-পত্রিকা সম্পাদনার গুরুভার বর্তায় তাঁর ওপর। তত্ত্বাবধায়ক ছিলেন বিভাগীয় প্রধান শ্রদ্ধেয় অধ্যাপক চিন্তাহরণ চক্রবর্তী। তাঁর কাছেই হাতেখড়ি লেখা নির্বাচন, কাটছাঁট করা, প্রুফ দেখার। ‘১৭৭৮ গ্রন্থচর্চা’ পত্রিকার জুন ২০১৫ ও ডিসেম্বর ২০১৫ সংখ্যায় ‘সম্পাদকের কত কথা’ শীর্ষক স্মৃতিমালায় তিনি তুলে ধরেছেন সে অভিজ্ঞতার কথা: “প্রায়ান্ধকার ঘর, কম্পোজিটারের মাথার ওপর ঝুলন্ত টিম টিম করা বালব। সামনে সাজানো মায়াবী বাক্স। তার খোপ একেক সাইজের। কালি ঝুলি, শিসের টাইপ, কেরোসিনের গন্ধ। গ্যালি, প্রুফ, প্রিন্টিং মেসিন।" সে-অভিজ্ঞতা থেকে তিনি জেনেছিলেন ট্রেডেল মেশিন পায়ে চালানো হয়, বড়ো ফ্ল্যাট মেশিন বিদ্যুতে চলে। শিখেছিলেন পেজ মেক-আপ, টাইপের পয়েন্ট-সাইজ চেনা, প্রুফ দেখা। হাতেকলমে কাজ করতে গিয়ে বুঝতে পারেন ‘স, ক আর ন’ হরফগুলো ছাপার কাজে সব থেকে বেশি ব্যবহার হয়, সব থেকে কম ‘ণ, ৎ, ঋ আর ঙ’।
এর পরে স্থানীয় ‘হোমশিখা’ পত্রিকায় সহ-সম্পাদনার কাজ করেন, হাতখরচ হিসেবে পেতেন পঁচিশটি টাকা। কাজটিতে আগ্রহ আর শেখার অদম্য বাসনা তাঁকে সম্পাদক হিসেবে তিলে-তিলে তৈরি করেছিল ভবিষ্যতের জন্য। পরবর্তী সময়ে তিনি সান্নিধ্য পেয়েছেন পুলিনবিহারী সেন, সাগরময় ঘোষ প্রমুখ স্বনামধন্য সম্পাদকদের। ‘এক্ষণ’-সম্পাদক নির্মাল্য আচার্য ছিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর সহপাঠী।
সহপাঠীরা সংঘবদ্ধ হয়ে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়ার সময় প্রকাশ করেন ন-জন কবির কবিতা সংকলিত হাতে-লেখা কবিতার বই অমৃত-যন্ত্রণা—এটি সুধীর চক্রবর্তীর প্রথম স্বাধীন সম্পাদিত বই। ডিমাই সাইজের বইটিতে হালকা নীল কনকোয়েস্ট কাগজের ওপর হাতের লেখাটি ছিল তাঁর বিখ্যাত সহপাঠী শিশিরকুমার দাশের। প্রচ্ছদটি এঁকেছিলেন দাদা সুনীল চক্রবর্তী। পরবর্তীকালে এটি মুদ্রিতও হয়েছিল। হাতে-লেখা সংস্করণে ন-জনের কবিতা থাকলেও মুদ্রিত সংস্করণে কবির সংখ্যা বেড়ে দাঁড়ায় সতেরো। কবিদের নামে চোখ বোলালেই বোঝা যাবে সম্পাদক হিসেবে লেখক (কবি) নির্বাচনের প্রথম প্রয়াসেই তিনি কতটা সফল ছিলেন। পরে অধ্যাপক হিসেবে তিনি সরকারি মহাবিদ্যালয়ে পড়ালেও নানা সময়ে জড়িয়ে পড়েছেন ‘শিলাদিত্য’ বা ‘পরিবর্তন’-এর মতো বাণিজ্যিক পত্রিকার সম্পাদনার কাজে। সম্পাদনা করেছেন বহু আকর গ্রন্থ। আর ‘ধ্রুবপদ’-এর বারোটি বার্ষিক সংকলনের গুরুত্ব আগেই উল্লিখিত হয়েছে।
তাঁর জন্ম হাওড়ায়। বেড়ে ওঠা, শিক্ষা, কর্মজীবন, গবেষণা লেখালেখি নানা সূত্রে তিনি বিভিন্ন জায়গায় ঘুরে বেড়ালেও তাঁর জীবনে প্রধান অবদান দুটি শহরের—ঐতিহ্যবাহী কৃষ্ণনগর ও মেট্রোপলিটান কলকাতার। তাই তিনি তাঁর জীবনকে অশীতিপর পর্বে মনে করতেন A Tale of Two Cities। শুধু সদর বা মফস‍্সল নয় জীবনের নানা পর্বে বিভিন্ন গ্রামে মেলায় ঘোরা, হরেক মানুষের সঙ্গে মেশা, কথা বলা তৈরি করেছিল শুধু তাঁর লেখক নয় সম্পাদক সত্তাকেও: “ভালো মাপের গবেষক বা লেখক হতে গেলে শুধু নয়, দক্ষ সম্পাদক হতে গেলেও লাগে গভীর অন্তর্দৃষ্টি আর গ্রাম শহরের মিশ্র সংস্কৃতির সঙ্গ। শুধু নাগরিকতা দিয়ে একটি জাতিপরম্পরা ও তার যাপনের মর্ম সম্পূর্ণভাবে আয়ত্ত হয় না, জানতে হয় তার শিকড়, যা ডালপালা মেলে পুষ্পিত ও ফলবান হয়ে থাকে গ্রামীণ জনবৃত্তে। অন্তত আমাদের বাংলাদেশের আসল প্রাণ-ভোমরা লুকিয়ে আছে পল্লিজীবনে তথা পল্লিমানসে। আমার সম্পাদক সত্তার বিকাশ ও শুশ্রূষায় বেশ ক’বছরের সরেজমিন বহু বহু গ্রাম পরিক্রমার অনাবিল আনন্দ জড়িয়ে আছে।”
এসব কারণে শুধু সম্পাদক নন তিনি লেখক হিসেবেও ছিলেন যে-কোনো পত্রিকার সম্পদ। অনায়াস দক্ষতায় দ্রুত প্রাঞ্জল ভাষায় তিনি উপস্থাপন করতেন কাঙ্ক্ষিত বিষয়টি। ব্যঙ্গ শ্লেষ হাস্যরস কথকতা গল্প বিবরণ দর্শন মিলেমিশে একাকার হয়ে যেত তাঁর পরিবেশনা গুণে।
হঠাৎ মনে পড়ে কোনো দুপুরে পাশাপাশি শুয়ে তাঁর কাছ থেকে শোনা একটি গল্পের কথা। ভোজনরসিক সুধীরবাবু এক রাতে নেমতন্ন খেয়ে বাড়িতে ফিরে দেখেন তাঁর বাবা জেগে আছেন। কনিষ্ঠ পুত্রের কাছ থেকে তিনি জানতে চান কী কী পদ ওই বাড়িতে হয়েছিল। শুনতে-শুনতে অধৈর্য হয়ে তিনি জিজ্ঞেস করেন, “সন্দেশ করেনি?” সেদিনের মেনুতে সন্দেশের অনুপস্থিতির কথা শুনে তিনি বড়োই ব্যথিত হয়ে সুধীরবাবুকে তৎক্ষণাৎ বলেন, “আলোটা নিভিয়ে দিয়ে যাও”। যে-কোনো পত্রিকায় অনেক রচনার মধ্যে সুধীর চক্রবর্তীর লেখাটি সর্বদাই লেখকের প্রসাদগুণ এবং উপস্থাপন দক্ষতায় হত অনন্য—ঠিক ভোজবাড়ির সন্দেশ-এর মতো। হয়তো সহৃদয় পাঠকও ভবিষ্যতে ওঁর লেখার অনুপস্থিতিতে একইভাবে হতাশ হবেন।


ডাউনলোড করুন

প্রকাশকাল: ১৬ ফেব্রুয়ারি, ২০২১
প্রচ্ছদ অলংকরণ ও শিল্প-নির্দেশনা: সোমনাথ ঘোষ

সম্পাদক: সৈকত মুখার্জি

লেখকসূচি
শিবাজী বন্দ্যোপাধ্যায়
রঙ্গন চক্রবর্তী
সুশোভন অধিকারী
অশোককুমার কুণ্ডু
দেবাশীষ দেব
দেবাশিস মুখোপাধ্যায়
দেবাশিস বসু
কৃষ্ণজিৎ সেনগুপ্ত
স্বপনবরণ আচার্য
রামকৃষ্ণ দে
পিয়ালী রায়
নন্দিনী নাগ
সুবীর সিংহরায়
জীবনপঞ্জি ও গ্রন্থপঞ্জি

গ্রাহক হোন
হরপ্পার গ্রাহক হতে গেলে বছরে তিনটি সংখ্যার জন্য মোট পাঁচশো টাকা দিতে হয়। (ডাকমাশুল আলাদা)
যোগাযোগ করুন ই-মেলে অথবা ফোনে কথা বলুন।

সরাসরি প্রাপ্তিস্থান
• হরপ্পার পরিবেশক পশ্চিমবঙ্গে অক্ষর প্রকাশনী, ১৮এ টেমার লেন, কলকাতা-৯ ও বাংলাদেশে বাতিঘর।
• কলেজস্ট্রিটে পাতিরাম, ধ্যানবিন্দু, দেজ, দে বুকস্টোর, উল্টোডাঙায় সুনীলদার দোকান, রাসবিহারী মোড়ে কল্যাণদার দোকান, রিড বেঙ্গলি বুক স্টোর, শান্তিনিকেতনে রামকৃষ্ণর দোকানের মতো বহু স্টলে হরপ্পা নিয়মিত পাওয়া যায়। এছাড়া অনলাইনে হরপ্পা বিক্রি হয়।
• পত্রিকা পেতে আপনি দপ্তরেও মেল করতে পারেন।

মুদ্রিত সংখ্যা
হরপ্পার যাত্রা শুরু ২০১৭-র অক্টোবর মাসে চতুর্মাসিক পত্রিকা হরপ্পা লিখন চিত্রণ-এর প্রকাশলগ্নে। মূলত সাহিত্য পত্রিকা হিসেবে হরপ্পা আত্মপ্রকাশ করে বাংলার শিল্পসংস্কৃতি আচার অনুষ্ঠান রীতিনীতি পালাপার্বণ প্রভৃতি নানা বিষয়কে দু-মলাটের ভিতর নতুন আঙ্গিকে তুলে ধরার লক্ষ্যে। দেখবেন চলুন...